পর্ব - ০ | ডাঃ মেরাজ মুহাম্মদের কুরআনিক ইয়ার, QY টেকনিক
কয়েকদিন আগে ড. মেরাজ মুহাম্মদ'র লেখা "রেভেলেশন: দ্যা স্টোরি অফ মুহাম্মদ (সাঃ)" - বই থেকে খুব ইন্টারেষ্টিং একটা বিষয় শিখলাম, 'কুরআনিক ইয়ার' বা বছর মনে রাখার QY টেকনিক। সেটা লেখার জন্যই মূলত লিখছি। মূল আইডিয়া হচ্ছে: আমাদের রাসূল (সাঃ)'র জীবনী সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই কিছু না কিছু জানি, যেমন: নবুয়তের শুরুতে মক্কার কষ্টের জীবন, এরপর মদিনায় হিজরত, বদরের-উহুদের-খন্দকের যুদ্ধ, এর মধ্যে আবার মেরাজের অলৌকিক ঘটনা, তার আগে তায়িফ বাসীর কাছে তাঁর তিরস্কৃত হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এই ঘটনাগুলো তাঁর ২৩ বছরের নব্যুয়তের কখন, কোন বছর ঘটেছে? কোনটার পর কোনটা ঘটেছে? - সেটা বলতে পারা মোটামুটি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। এই হিসাবের মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর আরবি বছর শুরু গণনার হিসাব। হিজরতের বছর আবার কিন্তু হিজরী বছর-১ না, সেটা ধরা হয় হিজরী বছর-০; সেই হিজরত আবার ঘটে নব্যুয়তের ১৩ তম বছরে! এই সব জিনিস ধারাবাহিক ভাবে মনে রাখার চমৎকার আর সহজ একটা উপায় ডাঃ মেরাজ মুহাম্মদ বের করেছেন। আমার পড়ে বুঝতে অসুবিধা হয় নাই। ছবি আর বিভিন্ন হিন্টস, রাইম ব্যবহার করে চমৎকার একটা মৌলিক টেকনিক বের করেছেন। আমার মনে হয়েছে এইটা সবাইকে জানানো উচিত। সেটাই লিখবো, একটু বড় হয়তো হবে, কিন্তু ধৈর্য্য ধরে পড়ার অনুরোধ করছি। শেষে উনার বইয়ের ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে দিবো, সেখানে উনার ইউটুব লিংক সহ আরো দরকারি রিসোর্স আছে।
প্রথম ছবি দেখুন। আমাদের রাসূল (সাঃ) হেরা গুহাতে প্রথম যখন ওহী পান, তখন তাঁর বয়স ৩৯ পার হয়ে ৪০ বছর চলছিল। এরপর তিনি আরো ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। সেই হিসাবে তাঁর মৃত্যু হয় ৬৩ বছর বয়সে। এই ২৩ বছরের সময়কালকেই নবুয়তের সময় বলা হয়। একটা ঘড়ির মতো যদি আমরা সময়টাকে ৪ ভাগে ভাগ করি, তাহলে ২৪/৪ = ৬ বছর করে একেক ভাগে পড়বে। এই প্রতি ৬ বছরে একেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে, যেটা ইংরেজি H- দিয়ে শুরু। শূন্য বছরে [ঘড়ির ১২ টার কাঁটা] যদি হেরা (Hera) গুহা হয়, ৬ বছরে [ঘড়ির ৩টার কাঁটা] রাসূল (সাঃ)'র চাচা হামজা (Hamza) আর উমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামকে শক্তিশালী করেন। তার ছয় বছর পর অর্থাৎ নব্যুয়তের ১২ বছর পর [ঘড়ির ৬ টার কাঁটা], ১৩তম বছরে হিজরত (Hijrah) ঘটে। এরপরের ৬ বছর পর অর্থাৎ ১৮ বছর পর ১৯ তম বছরে [ঘড়ির ৯ টার কাঁটা] হুদাইবিয়ার (Hudaybiyah) সন্ধি ঘটে।
দ্বিতীয় ছবি দেখুন। এরপর ডাঃ মেরাজ মহিউদ্দিন খুব চমৎকার ভাবে এই প্রতিটা ৬ বছরের ভাগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে রাখার চমৎকার সূত্র শিখিয়েছেন। আমরা যেমন দৌড় শুরু করার আগে ১-২-৩ বলি, ঠিক একই ভাবে রাসূল (সাঃ) কে যেন আল্লাহ তা'য়ালা প্রথম ৩ বছর নিরবে ইসলাম প্রচার করে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। আর চার নম্বর বছরে (Year four) প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার জন্য 'Go' বলেছেন। মনে রাখার আরেকটা সূত্র বলেছেন: যেন আল্লাহ রাসূল (সাঃ) কে প্রকাশ্য ফোরামে [ফোর (৪)-আম] ইসলাম প্রচার করতে বলেছেন। এরপর কুরাইশরা যখন মুসলিমদের নির্যাতন শুরু করে অসহ্য পর্যায়ে নিয়ে যায়, তখন প্রথম মুসলিমদের একদল 'আবিসিনিয়া' চলে যেতে বাধ্য হয়। এটা অনেক সময় প্রথম হিজরত হিসাবে পরিচিত। নবুয়তের পঞ্চম বা ৫ বছরে এই ঘটনা ঘটে। এটা মনে রাখার সূত্র হিসাবে লেখক বলছেন যেন পাঁচ আঙুলের হাত নেড়ে নেড়ে মুসলিমদের প্রথম দল [টা-টা বলে] রাসূল (সাঃ) কে বিদায় জানিয়ে আবিসিনিয়া [এখনকার আফ্রিকার ইথিওপিয়া] চলে যাচ্ছেন। আর ছয় বছরে তো আগেই বলা আছে যে হামজা (রাঃ) আর উমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
তৃতীয় ছবি দেখুন। এরপর পরের ৬ বছর, অর্থাৎ ৭ - ১২ বছর কী হয়েছে সেটা মনে রাখার সূত্র। প্রথম ১-২-৩'র মতো ৭-৮-৯ এই ৩ বছর যেন কুরাইশরা নির্যাতন চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে মুসলিমদের এক-ঘরে করে রেখেছিলো। Ban Years হিসাবে এই তিন বছর পরিচিত। সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করে মুসলিমদের না-খাইয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা কুরাইশরা করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে ১০তম বছর রাসূল (সাঃ) জীবনে সবচেয়ে কষ্টের সময় আসে। এই সময়ে রাসূল (সাঃ)'র সবচেয়ে বড় সমর্থক, তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) মারা যান। তাঁর পৃষ্টপোষক, যদিও ইসলাম গ্রহণ করেন নাই, তাঁর চাচা আবু তালিব মারা যান। আর এইসব বোঝানোর জন্যই লেখক ১০ তম বছরকে লম্বা করে এঁকেছেন। এ যেন Q 'র পেট-কাটা লাইন। সবাইকে হারিয়ে রাসূল (সাঃ) যখন সমর্থন পাবার আসায় তা'ইফ শহরে যান, তখনও তাঁকে মেরে রক্তাক্ত করে বের করে দেয়। আর এরপরই আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে সান্তনা আর শক্তি দিতে ইসরা-মেরাজে উর্ধাকাশে তাঁর কাছে নিয়ে যান। এটা ঘটে নবুওয়াতের ১১তম বছরে। এটা মনে রাখার সূত্র হিসাবে লেখক উল্লেখ করেছেন: Eleven rymes with heaven - অর্থাৎ ইংরেজিতে ইলেভেনের সাথে হ্যাভেন (বা বেহেশত/উর্ধাকাশ) ছন্দ মিলায়। আর এর পরের বছর, অর্থাৎ ১২ তম বছরে মদিনা থেকে মক্কায় আসা ১২ জন হ্বাজী রাসূল (সাঃ) কে মদিনায় আসার জন্য অনুরোধ করে, সুরক্ষা আর মেনে চলার প্রতিজ্ঞা করে। আর এটা প্রথম আক্বাবা বা প্রথম আনুগত্য হিসাবে পরিচিত।
চতুর্থ ছবি দেখুন। নব্যুয়তের ১৩ - ১৮ বছর এই ছয় বছর [আমাদের ওই ঘড়ির কাঁটার ৬ টা থেকে ৯ টা] ঘটা ঘটনাগুলো মনে রাখা একটু কঠিন। আগেই বলেছি ১৩ তম বছরে [ঘড়ির কাঁটার ৬ টার পর] মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত ঘটে। অর্থাৎ এর আগের ১২ বছর 'মাক্কী', আর এরপরের বছর গুলো 'মাদানী' হিসাবে পরিচিত হবে। হিজরতের পর সাময়িক শান্তি আসলেও একটার পর একটা যুদ্ধ হয়। এই ঘটনা গুলো ধারাবাহিকভাবে মনে রাখার জন্য লেখকের সূত্র হচ্ছে: Hijrah Resulted in Battle Upon Battle Till Hudaybiya. যার প্রতিটা শব্দের প্রথম অক্ষর একেক বছরে একেকটা ঘটনা নির্দেশ করে। Hijrah-র H ১৩ তম বছরে হিজরত, Resulted 'র R - ১৪ তম বছরে 'রেইড' যেটা মক্কার কুরাইশদের কাফেলায় মুসলিমদের হামলা বোঝায়; Battle Upon Battle - যথাক্রমে বদর, উহুদ আর বদর-২ কে নির্দেশ করে: যা নবুয়তের ১৫-১৬-১৭ বছরে হয়েছে। আর Till Hudaybiya 'র T - ১৮ তম বছরে ট্রেঞ্চ বা খন্দকের যুদ্ধ নির্দেশ করে।
পঞ্চম ছবি দেখুন। আর রাসূল (সাঃ) 'র জীবনের ১৯ - ২৩ এই শেষ ৫ বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে রাখার সূত্র গুলো হচ্ছে: আমরা জানি ১৯ তম বছরে হুদাইবিয়ার সন্ধি হয় [ঘড়ির কাঁটার ৯] । এরপর আল্লাহ তা'য়ালা কুরআনের আয়াত নাজিল করে পরিষ্কার ভাবে মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ দেন [সূরা কাসাস, সূরা নম্বর ২৮, আয়াত ৮৫]। চোখের দৃষ্টি শক্তির পরিষ্কার ২০/২০ ভিশন 'র সূত্র ব্যবহার করে লেখক ২০ তম বছরে মক্কা বিজয় মনে রাখতে বলেন। ২১ বছর বয়স যেমন পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্ত-বয়ষ্ক তরুণ হিসাবে গণ্য, একই ভাবে নবূয়তের ২১ তম বছরে ইসলাম যেন তার পুরো শক্তিতে শক্তিমান হয়ে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাবুকে যায়। ২২ তম বছরে কী ঘটেছে সেটা মনে রাখতে অবশ্য লেখক ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ায় শান্তি দেখাতে বাঁকা করে দুই হাতের আঙুলে V- চিহ্ন দেখিয়ে ছবি তোলার রেফারেন্স দিলেন। ২-২ বা ২২ তম বছরে সারা আরব থেকে বিভিন্ন আগের শত্রুভাবাপন্ন গোত্ররা এসে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূল (সাঃ)'র আনুগত্য প্রকাশ করে। আর ২৩ তম বছরে রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবনের প্রথম আর শেষ হ্বজ পালন করেন। বিদায়ী হজ্বের ভাষণ দেন। ইব্রাহিম (আঃ)-র পদাঙ্ক অনুসরণ করে করা রাসূল (সাঃ)'র সেই বিদায়ী হ্বজ অনুসরণ করে আমরা এখনো প্রতি বছর হ্বজ করে চলছি।
আর পুরা কুরআনিক ইয়ার বা QY টেকনিকের ছবি দেখতে ষষ্ঠ ছবিটি দেখুন।
ডাঃ. মেরাজ মহিউদ্দিনের বইয়ের লিংক: https://www.amazon.com/REVELATION-Story-Muhammad-Meraj-Mohiuddin/dp/0989628809
ডাঃ মেরাজ মহিউদ্দিনের বইয়ের ওয়েবসাইট: https://www.therevelationexperience.com/
[সবশেষ: কারো হয়তো মনে প্রশ্ন আসতে পারে, রাসূল (সাঃ)'র এই জীবনীর ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ জেনে আমার কি লাভ? আমার মনে হয়েছে: যেহেতু রাসূল (সাঃ)'র জীবনীকে বলা হয় চলন্ত কুরআনের উদাহরণ, আর তাই কুরআন ঠিকমতো বুঝতে এর আয়াতের কনটেক্সট জানা অত্যন্ত জরুরি, আর সেই হিসাবে ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট, কখন কোন ঘটেছে, সেটার সাথে কোন আয়াত নাজিল হয়েছে - তাও জানা জরুরি।]